বৌভাত

 এ দুটো দিন বিয়ের খুব ধকল গেল।

আজ কালরাত্রি। সকালে ধুমধাম করে বধূবরণ হয়ে গেছে। বৌভাত হবে রাতের বেলায়। মনোরমা বিয়ের পোশাক ছেড়ে একটা হালকা সুতির কাপড় পরে বাড়ীর পিছনের বাগানে বসে আছে। তাকিয়ে আছে মেহেন্দীর দিকে। দুপুরের রৌদ্রে মেহেন্দী‌ যেন কোনো লিপি। মনোরমা তারই পাঠোদ্ধার করছে কিন্তু পারছে কই। বারেবারে মনে পড়ছে বাবার মুখ,মার কান্না।আর মনে পড়ছে পরিবেশের বদল।কত লোকজন পেরিয়ে একটু একা বসেছে।কী যে ভালো লাগছে!



হঠাৎ, কেউ যেন পিছনের আঁচল ধরে টানছে। মনোরমা পিছন ফিরে দেখতেই একটা ছোটো ছাগল ছানা ম্যা-ম্যা করে উঠল। কালো ছাগল ছানাটি গোল গোল চোখ নিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে। নতুন বউয়ের নতুন আঁচলের খুঁট তার মুখে। দুটো কান হালকা ভাবে দুলছে। মনোরমা ছাগলছানাটাকে কোলে তুলে নিল।ছানাটার পালানোর কোন ইচ্ছাই নেই। নতুন বউয়ের সান্নিধ্য সবাই পেতে চায়।

ছাগল ছানাটি কোলে উঠে , মনোরমার গলার কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ঘষতে লাগল। মনোরমা এই স্বজন হারানো পরিবেশে একজনকে পেল যে শিকড় উপড়ানো গাছটাকে আদর করছে। স্নেহের পরশ দিচ্ছে।নরম কান গুলো কী অপূর্ব মায়া, বিশ্বাস নিয়ে গালের উপর বোলাচ্ছে ।আদুরে ডাকটা মনোরমার কত পরিচিত মনে হল।কত সহজেই আপন হয়ে গেল যেটা মানুষ হয়ত একশ বছর চেষ্টা করলেও পারে না। বুকের কাছে দলা পাকানো কষ্ট একটু একটু করে নরম হচ্ছে।একটা অবলা প্রান এত সহজে সব কিছু ভুলিয়ে আনন্দ দিতে পারে তা মনোরমার জানা ছিল না। ছানাটির প্রানের স্পন্দন এক নতুন ভালো লাগার জন্ম দিচ্ছে।

মনোরমা ছাগলটির গলায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল -তুই কোথা থেকে এলি বলত?
ছানাটা যেন কিছু বলার জন্য মনোরমার দিকে তাকাল কিন্তু বলতে পারল না।একটা মন কেমনের ভাব নিয়ে মুখটা মনোরমার মুখের খুব কাছে নিয়ে গিয়ে ম্যা-ম্যা করতে লাগল। শুধু অনেক আদর নিয়ে জড়িয়ে ধরল মনোরমা। চঞ্চল ছাগলছানা আরও কিছু বলছে। মনোরমা বলল- তোর খিদে পেয়েছে না রে?
ছাগলটা আরও চঞ্চল হয়ে উঠল বটে, মুখে কোন শব্দ করল না। মনোরমা বলল- চল তোকে কিছু খেতে দিই।

এমন সময় কে যেন বলে উঠল -ছাগল ছানাটাকে দিন।
মনোরমা মুখ না তুলে জিজ্ঞাসা করল- এটা আপনাদের বুঝি?ভারি মিষ্টি! ওকে জিজ্ঞাসা করছি, খিদে পেয়েছে কি না। কিছুতেই বলছে না।এক নাগাড়ে কথাগুলো বলতে বলতে ছাগলছানার মুখে চুম্বন করতে লাগল। লোকটি হেসে বলল - আজ্ঞে না নতুন বৌমা। আপনার বৌভাত উপলক্ষে আনা হয়েছে।
মনোরমা অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে মুখ উপরে তুলে বলল –আমার বৌভাতে?কই আমি তো কিছু জানিনা!
–আজ্ঞে হ্যাঁ। হয়েছেটা কি -আটখানা ছাগল এসেছে, এটা তার মধ্যে একটা।কখন যে এখানে চলে এসেছে!ওজন হয়ে গেছে,, আরও কিলো দুয়েক শর্ট পড়েছে। তাই এটা দরকার।
–দরকার মানে!
–বুঝলেন না! মাংস গো……রান্না হবে।

মনোরমা ছাগলছানাটাকে কোলে নিয়ে দৌড় দিল মাংস কাটার জায়গায়। গিয়ে দেখল তিনটা ছাগল ঘাস খাচ্ছে আর খেলা করছে।তারা জানেই না উদ্দেশ্যর নিষ্ঠুরতা। তারপর আর একটা ছাগলের দিকে চোখ যেতেই দেখল কেমন থর থর করে কাঁপছে, কিছুক্ষন পর মুখ থেকে চোল খানেক রক্ত তুলে নিথর হয়ে গেল। মনোরমা চিৎকার করে কেঁদে ফেলল। বুকের কাছে ছাগলছানাটা চঞ্চল হয়ে উঠে মনোরমার কাঁধে মাথাটা এলিয়ে বোঝাচ্ছে খিদে নয়,ভয় পাচ্ছে। আমাদের এই দেশে মাংসের মতো দুঃখী ও আদরনীয় আর কেউ নেই।

 এদিকে বিয়ের সানাইটা ইনিয়ে বিনিয়ে সবাইকে ভুল বোঝাতে ব্যস্ত।
সানাই-এর সুর অসাধারণ জাদুবলে ছাগলদের গোঙ্গানি কে ঢেকে দিচ্ছে।মূল রঙ্গমঞ্চে শুধু আনন্দ।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!