কলকাতা শহর আগের চেয়ে অনেক বেশি চঞ্চল হয়ে উঠেছে ।চঞ্চল হয়ে উঠেছে মানুষজনের পা, মন ,মানসিকতা। ধৈর্য্য ,অপেক্ষা খুব বিপাকে না পড়লে এখন আর কেউ করে না ।বেটার অপশন ।এই বেটার অপশনটা অপশন চেঞ্জ করে করে মানুষকে কোন বিটার অপশনে এনে নোঙ্গর ফেলে তা কম বেশি মানুষ অপশন choose করার পর বুঝতে পারে। তারপর রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে -প্রথমের অপশনটাই বেটার ছিল। দুনিয়ায় এত রকমের অপশন থাকা সত্ত্বেও রিহান কল রেকর্ডিংয়ের মায়ায় বলুন, মুগ্ধতায় বলুন সেখান থেকে বেরোতে পারিনি। তবে রিহান এটাকে ভালোবাসা বলে।
রিহান
বসাক এই কলকাতা শহরের একজন নামী বিজনেসম্যান ।বাবার ছোট্ট ব্যবসা কে পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়
দিয়ে একটা বড় পজিশনে পৌঁছেছে।রিহান ব্যবসার পাশাপাশি ছবি আঁকে গিটার বাজায় এবং ফ্রিতে
ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শেখায়। যতটা সম্ভব নিজেকে
ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে আর কল রেকর্ডিংয়ের
মানুষটাকে খুঁজে চলে। ছোটোবেলায় রিহানের মা মারা গেছেন ।বাবা আবার বিয়ে করেছেন। বাড়িতে
বাবা, ছোট মা, ভাই ,বোন আর রিহান থাকে। উত্তর কলকাতায় এক সুবৃহৎ ক্যাম্পাস জুড়ে রিহানের চারতলা বাড়িটা। বাড়িতে গাড়ি, দাস -দাসী এবং আধুনিকতায়
দৈন্যতার লেশমাত্র নেই । তবে ভালোবাসার দৈন্যতা রিহানকে করে দিয়েছে একেবারে সাধারণ
।রিহান তার ত্রিশ বছর বয়সে অ্যাচিভমেন্ট কাকে বলে দেখিয়ে দিয়েছে।
-“হ্যাঁ রে কৃশানু বল।”
ফোনের ওপারের কথাগুলো শোনা যায় না। তবে রিহানের হতাশ মাখানো কথাগুলো শোনা গেল -”হ্যাঁ
আমি ট্রেনে ওঠার আগে খেয়েছি।”
-” না, এবারও পেলাম না।”
-“ হ্যাঁ বাড়ি ফিরছি ।”
-”রাখি পরে কথা হবে।” ফোনটা রেখে রিহান ট্রেনের কামরটা ভালো করে
দেখে নিল। কোন নতুন মানুষ উঠেছে কিনা। সে নিজের প্রতি একটু বিরক্ত হল; ঘুমিয়ে পড়ার
কারণে ।আজ তিন দিন হল বাড়ির বাইরে আছে ।তাই
বেশ ক্লান্ত লাগছে। হঠাৎ,একদল মেয়ের হাসির শব্দ শুনে রিহান সিট ছেড়ে উঠে পড়ল।
পরের স্টেশন আসতে দেরি নেই ।রিহান মেয়ে গুলোর থেকে অল্প তফাতে
দাঁড়িয়ে উল্টো দিকে মুখ করে তাদের কথা ,হাসি কান পেতে শুনতে লাগলো ।কারো লম্বা চুল
বাতাসে উড়ে রাহানের গলা স্পর্শ করল। আবার কারো ওড়না হাতের কাছে পিঠের কাছে চঞ্চল
হয়ে ওঠে। রিহানের মনে হয় এই একদল মেয়ের মধ্যে ঠিক একজন হবেই হবে। আশায় বুকটা শিরশির
করে ক কাঁপতে লাগলো।স্টেশনে ট্রেন থামলে মেয়েরা নামতে শুরু করলে রিহান বেশ জোর করে
বলল -”মনি”! বেশ কয়েকবার মনি, মনি বলে ডাকল কিন্তু কোন মেয়েই পেছন ফিরে তাকালো না।
রিহানের আশায় বাঁধা লাল রিবন সুতোটা কেটে গেল ।রিহান আর না দাঁড়িয়ে পরের কামরায়
গিয়ে উঠে পড়ল।
রিহান যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত। প্রায়
বারোটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই করছে।নিজের রুমে ঢুকে দেখল তার প্রিয় পোষ্য সুখু তার আপেক্ষায় ।ব্যাগটা জায়গা মতো রেখে সুখুকে
জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো ।বলল -”সুখু ,আমাকে ও কেন এত কষ্ট দিচ্ছে বলতে পারিস? কেন
এত লুকোচুরি খেলা খেলছে ? সুখু কুঁই কুঁই শব্দ ছাড়া আর কিছু করল না। সুখু কে ছেড়ে মোবাইল বের করে কল রেকর্ডিংটা চালিয়ে
দিল।
প্রথম নম্বর কল রেকর্ডিং -
-”হ্যালো, কে বলছেন?”
-” আমি বলছি …..রিহান ।”
-”কোথা থেকে বলছেন ?”
-”কলকাতা থেকে।”
-” সরি ,রং নাম্বার ।”
-”আরে শুনুন ,আপনার নামটা
………..
বলতে বলতে রেকর্ডিং বন্ধ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় নম্বর রেকর্ডিংয়ে চালালো-
-“হ্যাঁ কে বলুন তো আপনি বারবার ফোন করে ডিস্টার্ব
করছেন!”
-” ভালো করে দুটো কথা বলে নিলেই আর ডিস্টার্ব করবো না ।”
-”চিনি না জানি না কথা বলব !তাও
আবার ভালো করে?”
-” ইচ্ছে থাকলে চেনা যায়, জানা যায়। কেন ,কালকে তো আমার নামটা
বললাম রিহান।আর আপনার নাম?”
-”রং নাম্বারে ফোন করে দাবি করছেন?”
-” হ্যাঁ করছি। রংটাকে রাইট করার জন্য।”
-”কোন কাজকর্ম নেই নাকি!”
-” অত রাগ করছেন কেন? আপনার গলার স্বরটা সত্যি খুব সুন্দর।”
-” আপনি অমনি শুরু করে দিলেন
ফ্লার্টিং করা ।আমি রাখছি।”
-”প্লিজ রাখবেন না। আপনার নামটা বলুন না প্লিজ।”
-” মনি ।”
রেকর্ডিং বন্ধ হয়ে যায় আর এই সময় দরজায় করাঘাত পড়ল।
দরজাটা খুলতেই দেখল তার
বোন রিমা খাবার নিয়ে এসেছে ।রিমা বলল
-”দাদা ভাই আর কতদিন এভাবে চলবে? সীমা বলে একটা শব্দ আছে।” টেবিলে
খাবারের প্লেট রাখতে রাখতে রাগ করে রিহানের দিকে তাকালো।
-”এত রাত পর্যন্ত জেগে
আছিস যে!”রিহান তার বোনের দিকে তাকিয়ে বলল।
-” তুমি খেয়াল করেছো এত রাত হয়েছে?,আর আমি জেগে আছি! কারো তো
কোনো মাথাব্যথা নেই সবাই তোমাকে ভুলে মেরে দিয়েছে। আমি ভুলতে পারি না।” রিমা দাদার
কাছে এসে শান্তভাবে বলল
-”দাদাভাই কেউ একজন ভালবাসল
না বলে তোমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল? বাবা আমি এই সুখু তোমাকে যে এত ভালোবাসি তার
কোন দাম নেই? -”আমি তাকে ভালোবাসি খুব ভালোবাসি
।“রিহান উদাস হয়ে বললো।
রিমা মুখ বেঁকিয়ে বলল -”হ্যাঁ ভালোবাসি! যাকে চোখেই দেখল না তাকে
আবার ভালোবাসা ।”কথাগুলো বলে রিমা দুটো প্লেটের ঢাকনা খুলে দিল। বলল -”খাবে এসো। হাতমুখ
ধুয়েছে তো” ?রিহানের হাতে টাওয়াল গুঁজে দিয়ে বলল-” যাও” ।
-” তুই এখনও খাসনি!”রিহান
অবাক হয়ে বলল।
-” নিজের হাতে প্রথম মাংস রান্না করলাম ।তোমাকে তো পেলাম না, না
রান্নার সময় না খাওয়ার সময়। তাই.. …যাও ,খিদে পায় না বুঝি।”
-”আমার মা ফিরে এসেছে।”রিমার মাথায় হাত রেখে বলল রিহান।
-”ফিরে আসেনি।বড় মা পাঠিয়েছে।বলেছে, আমি তো জব্দ করতে পারব না। তুই যা রিমা। ছেলেটাকে মানুষ কর।”
আকাশের
চাঁদটা বেশ বড় ।বোধহয় সামনেই পূর্ণিমা। কতগুলো সাদা মেঘের পাহাড় এসে চাঁদকে চারিদিক
থেকে ঘিরে ধরেছে। মাঝখানে চাঁদের মুখ আর তার উপর দিয়ে মাঝে মাঝে হালকা কালো মেঘ উড়ে
যাচ্ছে। যেন কোনো ছলনাময়ী মায়াবিনী তার রূপ সৌন্দর্য, দেহসৌষ্ঠব, আপতিত ভালোবাসা
নিয়ে হাতছানি দিচ্ছে। ধরা যায় না, পাওয়া যায় না। রিহান খাওয়া-দাওয়া সেরে বাইরের
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ।বলল -”ভালোবাসা দেবে না তো এতো ভালোবাসা গায়ে কেন মেখেছো ?চলেই
যদি যাবে তাহলে পিছন ফিরে তাকালে কেন ?গলার কাছে দলা পাকানো কষ্টটা আর বইতে পারছি না।”রিহানের
গাল বেয়ে নেমে আসে উষ্ণ নোনা জল।
রুমে ফিরে এসে তুলি, প্যালেট
রং নিয়ে ক্যানভাসের কাছে এলো ।এই নিয়ে ১১৩টা ছবি হবে। মনি কেমন দেখতে হবে তা নিয়ে
ছবিগুলো ।মনির কন্ঠ অনুসরণ করে তার অবয়ব আঁকে।কালো, ফর্সা, শ্যামলা ,তামাটে গায়ের
রঙের ছবিগুলো সারা দেওয়াল জুড়ে ভালোবাসার বড় জাহাজের ছোট-বড় পাল হয়ে আছে।
রিহান তৃতীয় কল রেকডিংটা চালালো।আর চললো প্রেমের প্রতিমূর্তি
আঁকার কাজ।
-”মনি কেমন আছো? কি করছো?’
-” কে?”
-’ আমি রিহান মনি।”
-” আপনি আবার ফোন করেছেন!”
-” প্রথম ফোন পেয়ে কৌতুহল বসে মনে এলোমেলো নাম্বার সাজিয়ে প্রথমেই
তোমার গলা পেয়েছি মনি ,তুমি জাননা এতে কতটা ভালোলাগা জড়িয়ে আছে।
-” ও তাই বুঝি ?তা মশাইয়ের কি
করা হয়?”
-” আমি বিবিএ পড়ছি।”
-” তুমি “?
-”আমি অভিমান হলে পড়ি”।
-” বৃষ্টি নাকি? তুমি থাকো কোথায়?”
-” দক্ষিণের খোলা জানলায় ।”
-”হ্যাঁ,দেখতে পাচ্ছি না, অনুভব করছি। আমার সারাঘরে বাতাস হয়ে
তুমি খেলছো।”
-”জানো মনি, আমার মাকে আমি দেখতে পাই না কিন্তু অনুভব করি আমার
মায়ের গায়ের গন্ধ।”
-” মায়ের জন্য খুব মন খারাপ
করে তোমার ?”
-”খুব ,বারে বারে মনে হয় মা আমার সাথে এটা না করলেও পারতো। মায়ের
যখন শরীর অসুস্থ ছিল আমি মায়ের গা ঘেষে শুয়ে অসুস্থ গলায় কত রূপকথা শুনেছি ।গাটা
ভীষণ গরম থাকত ,আমার খুব ভালো লাগতো। যেদিন মাকে ওরা সাজিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল আমি
বুঝতে পারিনি মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ।বাবা বলেছিল মা পাটরানী হয়ে গেছে ।রূপকথার রাজ্যে রাজত্ব করতে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম
রাজা নেই ?বাবা বলেছিল রাজা অন্য দেশে রয়ে গেছে তাই তোমার মার জরুরি তলব।”
-”তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল না
?”
-”তখন অত কষ্ট হয়নি। কষ্ট হয়েছিল যখন মাকে চিতায় তুলেছিল ।আর
আমি দৌড়ে গিয়ে মায়ের ঝুলে পড়া হাতটা নিয়ে আমার গালে রেখেছিলাম। মায়ের গায়ের
সেই উষ্ণতা টা আর পাচ্ছিলাম না বলে কষ্ট হচ্ছিল।”
-” তাই তুমি ঠান্ডা জিনিস পছন্দ করো না।”
-”হ্যাঁ, তুমি কি করে জানলে?’
-” যাকে তুমি খুব ভালোবাসো সে তোমার সব অপছন্দের মধ্যে থাকে।”
-” যা, কি বলছো।”
-” হ্যাঁ এই পৃথিবীতে ভালো -মন্দ, পছন্দ -অপছন্দ সব আছে। ভালবাসলে
সব গ্রহণ করতে হবে ,সব ভালবাসতে হবে ।মায়ের গায়ের উষ্ণতা ভালবাসলে, ঠান্ডাকে ও ভালোবাসতে
হবে। নাহলে মাকে আর ভালোবাসলাম কি করে বলো।গরম
ঠান্ডা দুটোই মায়ের গা। তাহলে তোমার অপছন্দের মধ্যে মা আছে না নেই?”
-”আছে মনি, তুমি যদি বাতাস
হও তাহলে তুমিও মায়ের গন্ধ বয়ে নিয়ে এসো।”
-”আমাকে অনেক কিছু বয়ে
নিয়ে যেতে হয়।”
-” তোমার অনেক কিছু বয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে আমাকে ও কিছু দাও।
হ্যালো…….. হ্যালো মনি ….. শুনতে পাচ্ছো!”
কল রেকর্ড বন্ধ হয়ে যায়।চাঁদটাকে কালো মেঘে ঢেকে দিয়ে প্রচুর
বাতাস দিচ্ছে। বোধহয় কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নামবে। রিহান বাইরের অবস্থা দেখে দক্ষিণ
দিকের জানলা খুলতে গিয়ে তার থেকে তুলিটা ক্যানভাস ঘেঁষে মেঝেতে পড়ে গেল ।সুখু একটু
চোখ মেলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল মাথা গুঁজে। একটা ঝড়ো হাওয়া এসে রিহানের ঘরে প্রবেশ করল,
রিহানকে , ক্যানভাসকে স্পর্শ করল। ক্যানভাসের কাছে ফিরে রিহান দেখল মনির ছবিতে ঠোঁটের
উপরে একটু লাল রঙের ফোঁটা পড়ে ছোটো বিন্দু হয়ে গেছে।মনিকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে!১১৩
নম্বর ছবির মাধুর্য বাড়িয়ে দিয়েছে, ওই লাল ছোট বিন্দুটা ।রিহান জড়িয়ে ধরে ছবিটাকে
। আবেগঘন গলায় বলল -”আমার মা আমাকে ছেড়ে
চলে গেছে ,তুমিও……… “। আর কথা বলতে পারল না ।সদ্য আঁকা ক্যানভাসের ছবিতে রিহানের চোখের জল পড়ে মনির চোখের কালো মনি গেলো
ঘেঁটে। চোখের মনির কালো রং গাল বেয়ে গলা দিয়ে নেমে বুকের বাঁ দিকটায় জমা হয়ে কালো
হয়ে গেছে ।রিহান বলল -’তিন দিনের মায়া যে সারা জীবন বইতে হবে তা তখন বুঝতে পারিনি।
আমাকে কি একটু ভালোবাসা যেত না মনি ?কি ছিল
তোমার কন্ঠে যা আজও আমাকে কাঁদায় !কি ছিল
তোমার কথা যা আজও ভালবাসতে শেখায় !কেন আমাকে এত চঞ্চল করে রেখেছো?”
রিহানের ফোন বেজে উঠেছে । ফোন করেছে কৃশানু। রিহান ফোন রিসিভ করে
ফোনটা লাউড স্পিকারে দিল। কৃশানু বলল-” কিরে বাড়ি ফিরেছিস ?তোর কি মাথাটা একেবারে
গেছে !তোর জন্য সে আরো বসে রয়েছে ?বিয়ে করে সংসার করছে। আর তুই একা ভ্রমণ করছিস।
শোন, তুই না পদব্রজে ভ্রমন কর তাহলে ব্যাপারটা জ্ঞানী জ্ঞানী হবে। যতসব!চোখের সামনে
,হাতের সামনে এত মেয়ে আছে কোথায় চিল করবি তা না ভালোবাসা খুঁজছে।”
-”তোকে বোঝাতে পারি না কেন!আমি তাকে ভালবাসি।”
-”লোকে বলে যে নিজে থেকে
লুকিয়ে যায় তাকে খোঁজা যায় না। তুই ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে নিজের অহেতুক জেদটা খুজছিস
।”
-”জেদের থেকে বড় কিছু যদি থেকে থাকে সেটা বলতে পারিস। কাউকে ভালবেসে
সারা জীবন আগলে রাখাটা সত্যি জেদের।”
-’যা খুশি কর। শোন, আমার একটা বন্ধুর খুব পপুলার ইউটিউব অডিও স্টোরি চ্যানেল রয়েছে। তোর জীবনের
গল্পটা অডিও স্টোরির মাধ্যমে বললে যদি কোন খোঁজ পাওয়া যায়। তুই কি বলিস?”
-” ভেবে বলছি।”
-” ঠিক আছে গুড নাইট”।
দিন চারেক পর ৩০ মিনিটের একটা ছোট্ট গল্প শোনার পর রেহান ভাবছে জীবনের অনুভূতিটাকে
গল্প বানিয়ে কি ভুল করলাম ।যদি মনি রেগে যায়। পরম মুহূর্তে ভাবে না না ভুল বা রাগের
কোন জায়গা নেই ।মনিকে খুঁজে পেতে হবে। চিন্তার
ফাঁকে ফাঁকে ইমেইল, অডিও কমেন্ট চেক করছে বারবার। অডিওর ডেসক্রিপশনে থাকা ইমেইল মাধ্যমে মনিকে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে ।একই সঙ্গে ফোন নং দেবে ভেবেছিল কিন্তু মনির কাছে ওই
নং আছে । থেকে ও কি লাভ হল ? চাইলে পারতো না একবার ফোন করতে! সত্যি,হঠাৎ খুঁজে পাওয়া
মানুষগুলো হঠাৎই কোথায় চলে যায় ।যেন স্রোতে ভাসতে ভাসতে দুটো খড়কুটো একসাথে কিছুটা
সময় ছিল আবার স্রোতের টানে কাকে কোথায় টেনে নিয়ে আলাদা করে দিয়েছে। রিহান কত কি
ভেবে চলে ।সময় কাটতে চায় না ।
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা
হলো।মনি ফোন করল না।রিহানের হতাশ ভাবটা উত্তর উত্তর বাড়ছে।বুকের কাছে ভালো লাগা, ভয়
একসাথে তালগোল পাকিয়ে সৃষ্টি করছে এক চাপ সৃষ্টিকারী জটলা। একটা একটা ঢেউ আসছে আর পায়ের তলায় বালি একটু একটু
করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পায়ের তলাটা কেমন শিরশিরিয়ে ওঠে। রিহান আজ ঘরে দোর
দিয়েছে। ডাকের প্রতীক্ষায় প্রহর গোনা হৃদয় দরজা খুলবে ডাক এলে।কিন্তু কত দূরে সে ডাক !
রিহান আবার গল্পটা চালালো।শুনছে নিজের গল্প। বৃষ্টির ঝরঝর শব্দ,
পাতার মর্মর শব্দ, পাখির ডাকাডাকি শব্দ, পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত শব্দ, সমুদ্রের
ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ, সবটা শুনতে শুনতে রিহান এর মাঝেই শুনতে পেলো মনি বলছে-” পৃথিবীতে
এত শব্দের মাঝে আমার গলার আওয়াজ হারিয়ে গেছে রিহান ।”মোবাইলে নোটিফিকেশনের শব্দে
রিহানের তন্দ্রা কেটে গেল। গল্প শুনতে শুনতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল বুঝতে পারেনি।গল্পটার
শেষ কিছু লাইন শোনা যাচ্ছে-” মনি তুমি যোগাযোগ কর ইমেইলের মাধ্যমে। রিহান তোমার প্রতীক্ষায়।
আরো একটা গল্প নিয়ে পরের সপ্তাহে হাজির হব ।ততক্ষণ সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন
।সবার দিনটা ভাল কাটুক।”
রিহান তড়িঘড়ি নোটিফিকেশনটা খুলল। রাত প্রায় দশটা বাজে। বুকের
বাঁ দিকটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে , মনি ইমেইল করেছে!চোখ দুটো ভালো করে কচলে নিয়ে
অপার বিস্ময়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ইমেইল টা খুলে দেখলো হাওড়ার একটা ঠিকানা। ইমেইল টা
আসছে মেঘমালা রায়চৌধুরী থেকে।পরে আবারো একটা ইমেইল আসে ওই মেঘমালা রায়চৌধুরী থেকে, তাতে লেখা -মনি।
কোথা থেকে একটা জোনাকি এসে ঘরে ঢুকলো ।লুসিফেরন বাতাসের সংস্পর্শে
এসে জ্বলছে আর নিভছে ।জোনাকিটা রিহানের কাঁধে এসে বসল । তা লক্ষ্য করল না রিহান।আসা
ইমেলের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। তারপর হঠাৎ কি মনে হতে তাড়াতাড়ি উঠে সারা ঘর
গোছাতে লাগলো। একপাশের দেয়াল জুড়ে এক টানা সাজিয়ে রাখলো ১১৩ খানা ছবি। জোনাকিটা
রিহানের কাঁধ থেকে উড়ে গিয়ে বসেছে ১১৩নং ছবির উপর; ঠিক কালো হয়ে যাওয়া বুকের উপর । জ্বলছে আর নিভছে
।কালো রংটা একবার আলোকিত হচ্ছে আবার কালো হয়ে যাচ্ছে।রিহান দেখল ছবিটা কিন্তু কাছে
গেল না। পাছে জোনাকি টা উড়ে যায়। রিহান মনে মনে ভাবল কে বলে আনলাকি থার্টিন, থার্টিন
তো রিহানের লাক হলো!ও আর দাঁড়ালো না।আলমারিটা খুললো । রামধনুর সাত রঙ মিলিয়ে শাড়ি কিনেছে। কোনটা পছন্দ হবে মনির? আলমারির তাক
ভরানো উজ্জ্বল আনকোরা শাড়ি গুলোর থেকে একটা তুঁতে কালারের শাড়ি বের করলো। আর বের
করল মায়ের সোনার কানের দুল জোড়া।
এবার রিহান বেরিয়ে এলো
বাগানে। রাত একটা মতো বাজে। পাম্প চালিয়ে পাইপ দিয়ে জল দিলো পুরো বাগানে।
ভেজা মাটির গন্ধ,মনি আসার আনন্দে রিহানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হাজারো রঙ আর রঙিন ফুল ফুটতে
লাগল।আজ, ছোটোবেলায় মায়ের কাছে শোনা রূপকথার রাজপুত্তুর সে।এখনি মনি ছুটে এসে পিছন
থেকে জড়িয়ে ধরে বলবে-”সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে যখন এসেই গেছো তখন সোনার কাঠি
ছুঁইয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গাবে তো?”রিহান হেসে বলল -”তোমাকে কালই আমি নিয়ে আসব। আমার এই
রাজ্যে প্রতিটি জিনিস তোমার প্রতীক্ষায়।”গুনে গুনে ১১৩ খানা গোলাপ তুলে নিয়ে বাড়ীর
ভেতরে এলো।
বাড়ির পোষা টীয়া জোড়াকে জাগিয়ে দিল ।ময়নার মাথায় একটা টোকা
মেরে খাবার দিয়ে বললো -”তাড়াতাড়ি খেয়ে নে”। টীয়া আর ময়না পাখি গুলো খুব একটা
আমল না দিয়ে অন্যত্র চলে গিয়ে আবার ঝিমোতে লাগলো।অ্যকোরিয়ামের ফাইটার মাছগুলোকে
খাবার দিয়ে বললো-” জানিস ,কাল আমার মনি আসবে ।এলে আদর করে দিস কিন্তু!” সুন্দর রঙিন
ফাইটার মাছ গুলো কথা শুনে নীল- কমলা -হলুদ -সাদা পাখনা গুলো পাতলা ওড়নার মত উড়িয়ে
নিয়ে অ্যাকোরিয়ামের একেবারে তলায় গিয়ে বসে পড়ল।রিহান রুমে গিয়ে আলো নিভিয়ে সুখুর
পাশে শুয়ে সুখুকে একটু আদর করে জাগিয়ে দিতে চাইলে সুখু উঠল না।বিছানায় শুয়ে সিলিং
এর দিকে তাকিয়ে। এমন সময় সেই জোনাকিটা উড়ে এসে রিহানের হাতে এসে বসলো। সারা ঘর অন্ধকার
আর ওইটুকু আলো জ্বলছে আর নিভছে ঠিক ঐ ইমেইলটার মতো। রিহানের চোখে বিস্ময় জাগে।আজ এতগুলো
বছর পরে এই একরত্তি প্রানীর আলোটা পৃথিবীর অন্যান্য বিষ্ময়ের চেয়ে কম কিছু না। এতদিন খেয়াল করে নি। আমাদের চারপাশে এমনই অনেক
তুচ্ছ জিনিস থাকে,একটু খেয়াল করা হয় না বলে সারাজীবন অচেনা, অসুন্দর হয়েই থেকে যায়।
রিহান জোনাকির দিকে তাকিয়ে বলল- “জোনাকি, মনির কাছে একটু যাবি? দেখে আসবি কি করছে?
গিয়ে আবার বলবি না যে, আমি পাঠিয়েছি। তুই দূর থেকে দেখেই চলে আসবি।” জোনাকি গেল না।
রিহান ও জোর করলো না।এক অদ্ভুত ভালো লাগা মনটাকে ভরিয়ে তুলেছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে
রিহান ঘুমিয়ে পড়ল।
সুখু ভীষণ চিৎকার করে
সারা পাড়া একেবারে মাথায় করেছে। রিহান রাতে দরজা লাগিয়ে শুয়েছিল। সকালে সুখুর ভীষণ
ইয়ে পেয়েছে,বাইরে যেতে পারছে না।তাই সারা পাড়ার লোক জাগাবে। রিহান চিৎকার শুনে উঠে
দেখল সুখুর অবস্থা আর দেখল বেলা তরতরিয়ে বাড়তে । তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে একশো তেরো
খানা গোলাপ, তুঁতে কালারের শাড়ি, কানের দুল জোড়া নিয়ে ছুটল ভালোবাসার ঠিকানায়।
হাওড়ার ঠিকানায়
পৌঁছে একটা প্রায় জীর্ণ পুরোনো বাড়ীর সামনে দাঁড়ালো রিহান।বাড়ীটাকে দেখে হোম বলে
মনে হচ্ছে। সাইনবোর্ড একটা আছে তবে কোন রাগে না দুঃখে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে তার
বলা যায় না। রিহান আবার ঠিকানা পড়ে নিয়ে ধীরে পদে বাড়ীটার দিকে এগিয়ে গেল।
বাড়িটা সামনের দিকে একটা ঘর। আর তাতে একজন মহিলা কাগজপত্রের মুখ
ডুবিয়ে খসখস করে লিখে চলেছেন। বয়স আন্দাজ ৪৫ হবে। রিহান ভাবল মেয়েদের হোমে ছেলেকে
এলাও করবে! রেহানের কেমন খটকা লাগলো ।মেয়েদের হোমে কথাবার্তা নেই, হাসাহাসি নেই এত
চুপচাপ কেন! যাইহোক, রিহান কি বলবে ভেবে পেল না। মনি বলবে না মেঘমালা বলবে। তারপর বলল
-”এক্সকিউজ মি “
ভদ্রমহিলা মুখ তুলে চাইলেন তারপর শান্ত হয়ে বললেন -’হ্যাঁ বলুন।
-”মেঘমালা………….”রিহান
জড়তা নিয়ে বলল।
-” হ্যাঁ ,আমিই মেঘমালা। আপনি রিহান বসাক তো ?”
-”হ্যাঁ …..মানে মনি……”
-”মনি আপনার কথা আমাকে বলে রেখেছে। ও বলেছে আপনি এলে যেন আমি আপনাকে
ওর ঘরে পাঠিয়ে দিই।”
-”না না আপনি এখানে আসতে
বলুন ।এখানেই কথা বলে নেব ।”
-”কিন্তু ও যে আমাকে বলেছে……”
-”বুঝতেই পারছেন মেয়েদের
হোম রুমে যাওয়াটা ঠিক হবে না ।আপনি তাড়াতাড়ি ডেকে দিন।”
-’তাড়াতাড়ি হবে না ।একটু অপেক্ষা করতে হবে।” কথাটা বলে ভদ্র
মহিলা কাকে যেন ফোন করলেন। তারপর ফোন রেখে বললেন-” চলুন আপনাকে ভিতরে ডাকছে “।তারপর
হঠাৎ থেমে বললেন -”দাঁড়ান আপনি কি কিছু এনেছেন মনিকে দেওয়ার জন্য?’
রিহান ইতস্তত করে বললেন -”হ্যাঁ এই শাড়ি আর কানের দুল।এই
গোলাপ ……….”
ভদ্রমহিলা রিহান কে কোনো
প্রশ্নের পুরো উত্তর দিতে দিচ্ছে না। তাড়াতাড়ি করে বললেন -”শাড়িটা আমায় দিন ।কানের
দুল পকেটে রাখুন। গোলাপ নিজের হাতেই দেবেন না হয়।”কথামতো রিহান শাড়িটা এগিয়ে দেয়
ভদ্র মহিলা দিকে । ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলেন।
রিহানের হৃদয় থেকে থেকে মোচড় দিয়ে উঠছে।”সত্যি মনির সাথে দেখা
হবে !আজ এত দিনের অপেক্ষার অবসান ঘটবে? আবার সেই চির প্রতিক্ষিত মনির গলা শুনতে পাবো
!সেই কথাগুলো ভেবে যেমন ভালো লাগছে আবার এটা ভেবে খারাপ লাগছে যে মনি চাইলে ছুটে আসতে
পারতো না কিংবা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না।মেয়েটার হেঁয়ালি আর গেল না
।দুষ্টু ভারী দুষ্টু ।খুব করে বকে দেবো তোমায়। তখন তোমার অভিমান হলে কেমন লাগবে মনি?
আমি অভিমান করব ।দেখি তুমি কেমন করে ভাঙাও ।দেখব কেমন করে তুমি আমার হৃদয় পাহাড়ের
গা বেয়ে ঝরনা নাম ও, কেমন করে রামধনুর সাত রঙ ভরিয়ে সাদাকালো ছবি রঙিন করতে পারো
,কেমন করে আমার জীবন নদীকে গতি দাও।”এতগুলো বছর ধরে রিহান মনিকে মনের কাছে রেখেছে কোন
বাধা নেই, বিঘ্ন নেই। শারীরিকভাবে কাছে যাওয়াতে এত বাধা বিঘ্নের কারণ ?ভালোবাসার ক্ষেত্রে
মনটা কোনো না কোনোভাবে ঠিক জিতে যায় ।শরীর তো উপলক্ষ মাত্র ।
রিহান চমকে উঠলে ভদ্রমহিলার ডাকে।
ভদ্রমহিলা বললেন -”আসুন ,হেজিটেট করবেন না। সাধারণত আমরা ছেলেদেরকে
এলাও করি না তবে ,আমরা আপনাকে এলাও করছি। বলতে পারেন মনির বিশেষ অনুরোধে।”
রিহান ভদ্র মহিলাকে অনুসরণ
করে ভেতরে চলে গেল।
একটা দরজা বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা ।ভদ্রমহিলা ঘরটা দেখিয়ে
বললেন -”এটা মনির ঘর”
রিহানের বুকটা কেমন চিনচিন
করে উঠলো। ভালোবাসার মানুষটার সামনে যেতে এমন কেন হচ্ছে? রিহান কি একটা বলতে যাবে এমন
সময় ভদ্রমহিলা বললেন-” শুনুন মনির টাইটেল জানার আগ্রহ প্রকাশ করবেন না। মনি বলে- দুদিনের
পৃথিবীতে এসে টাইটেল গুলো বড্ড জ্বালায়। টাইটেল জানার পরে তারা জাতি নির্বাচন করতে
বসে।সেটা মনির ভালো লাগেনা ।আর এতদিন পরে দেখা অভিমান করবেন না।কারণ মনি বলে- “হোমে
থাকা মানুষদের অভিমান করতে নেই । অভিমানের নামে অভিনয় করা সাজে না।” ভদ্রমহিলা চলে
গেলেন।
ভালোবাসার স্বভাব বলুন বা মুদ্রাদোষ বলুন রিহান চুলে আঙুল চালিয়ে ঠিক করে নিল।জামার কলার ঠিক করে নিয়ে একটা হাসি হাসি মুখ নিয়ে দরজায়
টোকা মারল। ব্যাপারটা থ্রিলারের থেকেও কম কিছু নয়। দরজাটা টোকা মারতেই দেখল দরজাটায়
ছিটকিনি দেওয়া নেই। অল্প খোলা দরজা দিয়ে রজনী ফুলের গন্ধ আসছে ।রিহান ভাবল আমি তো
গোলাপ আনলাম এখন তো দেখছি রজনী ফুল মনির খুব পছন্দের ।শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল-”আসব
মনি ?”কোনো উত্তর এলো না। রিহান আবার বলল-”মনি আসব?”কোনো উত্তর এলো না ।রিহান বারবার
তিনবার কথাটা মনে করে আবার বলল -”মনি ভেতরে আসবো?” কোনো উত্তর এলো না। রিহান একবার
তাড়াহুড়ো করল না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবল মনি কি তার সাথে মশকরা করল! না ,মনি
নয়। তার আগেই ভাবা উচিত ছিল অন্য কেউ মজা করছে। মনি হলে নিশ্চয়ই সাড়া দিত ।কেউ বা
কারা ভুল ঠিকানা দিয়ে লুকিয়ে মজা দেখছে ।তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে ।রিহানের ভ্রু
জোড়া একেবারে কুঁচকে গেছে ।তার ভালোবাসাকে এভাবে প্রকাশন করে দিল! আশার এত কাছাকাছি
থেকেও ধৈর্য ধরতে পারছে না ।রিহান আবার ডাকল-” মনি ,মনি তুমি কি রুমে আছো ?”কোন উত্তর
এলো না ।রিহান ফিরে যাবে ঠিক করল। মনির লুকিয়ে থাকাটা, কথা না বলাটা এবার বেশ বিরক্তির
কারণ ঘটায়। আচ্ছা মনি কি সত্যি রিহানের অপেক্ষা করে ?সে কি সত্যি ভালোবাসে? সে কি রিহানের সঙ্গে থাকতে চায় সারা জীবন ?এই কথাগুলো
রিহান কোনদিন ভাবেনি। বলতে গেলে মাথায় আসেনি ।রিহান ভাবলো টানবিহীন একটা একতরফা টানাটানি
করেছে মাত্র ।এতদিনের ভুল ধারণা- শুধু সেইই ভালোবাসে, মনি ভালোবাসে না । ভালোবাসার
নামে যে বিশ্বাস,আস্থা পোষন করতে আজ আরো একবার ব্যর্থ হল। রিহান এক পা বাড়িয়েছে ফিরে যাওয়ার জন্য এমন সময় দরজার সামান্য ফাঁক
দিয়ে একটা হাত রিহানের ডান হাতের কব্জি ধরে ফেলল। রিহান চমকে উঠল। ভেতর থেকে একটা নরম মেয়েলি কণ্ঠ বলল -” ভেতরে আসুন।” এতদিন যখন
ভাবেনি আজ এই মুহূর্তে ভেবে কি করবে? রিহান সংকোচ, অভিমানী, বিরক্ত ভুলে রুমের ভেতর
এলো।কি অন্ধকার রুমটা! রিহান বলল -”আলো জ্বালাও নি কেন?”কোনো উত্তর নেই।
দরজা ছেড়ে এক পা এগোতেই ভেতরে থাকা মানুষটা দরজা বন্ধ করে দিলো।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঘরটা কি শান্ত।কোথা থেকে একটা জোনাকি
এসেছে ।ওড়ার গতিপথ অনুসরণ করে দেখলো জোনাকিটা এক জায়গায় স্থির ভাবে বসে জ্বলছে আর
নিভছে ।ওইটুকু আলোতে চিনতে পারল তুঁত কালারের শাড়িটাকে । অপেক্ষার একদিন।রিহান ভাবল
মনি শাড়িখানা পরে বসে রয়েছে। এক অদ্ভুত ভালো লাগা, নতুন মুখোমুখি হওয়ার ভয় ঘিরে ধরল ।এত কাছাকাছি থেকেও পা সরছে না ।হঠাৎ
,মনে পড়ে গেল গতকাল রাতে ১১৩ নম্বর ছবির
বুকের উপর বসে ছিল জোনাকিটা। বুকের বামদিকে
কালো হয়ে যাওয়া অংশে। এমন সময় এক রাশ আলো
এসে রিহানের চোখ ধাঁধিয়ে দিলো।
ঘরের দক্ষিণ দিকের জানলা খুলে দিয়েছে। রিহান ধাতস্থ হয়ে দেখলো
তার দেওয়া তুঁতে কালারের শাড়িটা পরে একটা মেয়ে শুয়ে আছে ফাঁকা ঘরের ঠিক মাঝখানে।তার
পাশে পড়ে রয়েছে একটা ছোট্ট ফোন আর ডায়রি। মেয়েটাকে দেখে রিহান বেশ অবাক হলো।
গতকাল রাতে আঁকা ছবিটার সঙ্গে গায়ের রঙের বেশ মিল আর ঠোঁটের উপরে
লাল তিলটা জ্বলজ্বল করছে!একটা বছর বারোর মেয়ে রিহানের হাত ধরে নিয়ে গেল মেয়েটার কাছে । রিহান নির্বাক।
মেয়েটা বলল-” এই হলো মনি ,আপনার মনি।”
রিহান গোলাপ ফুল গুলো পাশে রেখে বসে পড়লো মনির কাছে। এক দৃষ্টিতে
তাকিয়ে রয়েছে মনির দিকে। মেয়েটা বলল -”মনি আর চোখ মেলে তাকাবে না ।ওর গলায় অনেকদিন
ধরে অসুখ করেছিল।” পাশে থেকে ডায়েরিটা তুলে নিয়ে বলল -”এটা আপনার। আর এখানে একটা
হাসপাতালে ঠিকানা আছে ।আপনি চারদিন পরে ওখানে যাবেন। মনির চোখ আপনাকে দেখতে চায়। কাল
মনি আপনার গল্প শুনেছে।”
মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা থাকার কারণে এতক্ষণ যে হোমকে চুপচাপ
নিঃশব্দ মনে হচ্ছিল এখন সেই হোমের কোন এক রুম থেকে গান ভেসে আসছে -”যখন নীরবে দূরে
দাঁড়াও এসে “।
আজ রিহান মনিকে আরো বেশি করে ভালবাসছে ।মনির বলতে পারা না পারা, লুকোচুরি, ঠান্ডা শরীর সব ভীষণ পছন্দের
।রিহান দেখলে মনির বুকের উপর জোনাকিটা এখনো জ্বলছে আর নিভছে ।জল ভরা চোখে জানলাটার
দিকে তাকালো। একটা বাতাসের ঝাপটা এসে স্পর্শ করলো রিহানের চোখ দুটোকে। দুপুর গড়িয়ে
বিকেল বেলায় দূরের লাল কৃষ্ণচূড়া গাছটার ফাঁকে আধ ক্ষয়িষ্ণু চাঁদটা মুখ লুকিয়েছে
নীরবে।