গৌর আজ খুব ব্যস্ত।
বছর দশেকের গৌরের পরনে নীল হাফ প্যান্ট, সাদা জামা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ীর কাঁচে নিজেকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারেনি।রোগা লিকলিকে চেহারায় পোশাকটা বেশ মানিয়েছে। সামনে হাত দুটো জড়ো করে সোজা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে হেসে দেখেছে বেশ লাগছে কিন্তু।
শহরের লুকোচুরি খেলতে থাকা ঘরবাড়ী, ফুটন্ত পিচের ওপর চলন্ত গাড়ীর রেশ, উত্তপ্ত বাতাসের আকন্ঠ তৃষ্ণা আর এরই মাঝে ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়েছিল এক সুবিশাল গাড়ী।তার মধ্যে পুরোনো জামাকাপড়ে ঠাসা। গৌরের ভাগ্যে এই ড্রেসটা পড়েছিল।আজ কাজের ফাঁকে ফাঁকে জামার হাতার কাছটায়, বুকের কাছটা পরিস্কার করে নিচ্ছিল গৌর।বলা যায় না কখন মাইকে তার নাম ডেকে বসে।
উত্তর পাড়ার সৃজনী সংঘের সদস্যরা যখন ফুটপাতে হন্যে হয়ে কি একটা খুঁজছিল তখন গৌর আকাশের তারা গোনার মতো রাস্তার লোক গোনায় ব্যস্ত ছিল। সংঘের সভাপতি বিজনদাই প্রথম আবিষ্কার করেন গৌরকে।গৌরকে ডেকে বিজনদা বলেছিলেন - শোন, আমরা সংঘে পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠান করব। তুই কি আমাদের সঙ্গে যোগদান করবি? ভালো খাবার পাবি …….
– দাদা,আমায় কি করতে হবে?গৌর ভ্রু কুঁচকে বলেছিল।
– আরে না না…তোকে কিছু করতে হবে না।বিজনদা আকর্ণ হেসে গৌরের পিঠ চাপড়েছিলেন।
–এ বাজারে আমাকে ভালো খেতে দেবেন, এটাতো আর শুধু শুধু নয়!কী করতে হবে?
– বৈশাখ মাসে জল দানে পুন্য হয় জানিস তো।হ্যাঁ,যে বা যারা জল চাইবেন তাদেরকে জল দান করবি। এই যা।
–আমি সব করে দেব , একটা কথা রাখতে হবে।
–কী কথা বল শুনি।
–আমাকে একটা কবিতা বলতে দিতে হবে।
– তুই! কবিতা না ছড়া?বিজনদা হেসে বললেন।
–কবিতা । প্রশ্ন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
– বেশ বলিস না হয়। তাহলে আগামীকাল সকাল থেকে সংঘে চলে যাবি।
বিজনদার আশ্বাস পেয়ে গৌর ছুট দিয়েছিল রাস্তার পাশে বিরাট ঝাঁ চকচকে কোম্পানির দিকে। থেমে ছিল গেটের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে গৌর বলেছিল –
–দারোয়ান কাকু, দারোয়ান কাকু ওরা বলেছে আমাকে কবিতা বলতে দেবে।
– বলত শুনি-
শহরের উজ্জ্বল সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত দারোয়ান কাকুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে কবিতা বলেছে। দারোয়ান কাকুর শিখিয়ে দেওয়া কবিতাটা বছরের শুরুতে প্রশ্ন চিহ্ন এঁকে দেবে সংঘের বুকে। কবিতা বলতে বলতে কখন যে চেয়ারে বসে থাকা দারোয়ান কাকুর হাঁটতে মাথা এলিয়ে দিয়েছিল গৌর বুঝতে পারেনি।
সৃজনী সংঘের অনুষ্ঠান সকাল নটা থেকে শুরু হয়ে এখন বিকেল তিনটা। কত সুরহীন গান,কত মুদ্রাহীন নাচ,কত ছন্দহীন কবিতা বলা হয়ে গেল।গৌর জল দেওয়া, ফুলের তোড়া এগিয়ে দেওয়া, চেয়ারের কাপড় ঠিক দেওয়ার মাঝে মাঝে কতবার বিজনদাকে বলেছে, একটা কবিতা বলবে। প্রতিবার বিজনদা বলেছেন- এই ব্যাজটা হয়ে গেলে তুই খেয়ে রেডি থাকবি।গৌর খায়নি। খেতে বসে যদি তার নাম ডাকে তখন!
বিজনদা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে স্টেজ থেকে নামতেই দেখতে পেল গৌরকে। বললেন – এ হে হে হে,তোর কথাটা একেবারেই মাথায় ছিল না।আর একটু আগে এলে………বেটার লাক নেক্সট টাইম।
গৌর চোখের জল মুছতে মুছতে এসে বসেছে মোড়ের মাথায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ট্যাচুর নীচে। পড়ন্ত সোনালী আলোতে গৌর ঝাপসা চোখে দেখতে পেল দূরে নীল জামা কালো প্যান্ট পরে দারোয়ান কাকু দাঁড়িয়ে।
পয়লা বৈশাখের গোধূলীতে গৌর স্পট উচ্চারণের সঙ্গে লাইনের পর লাইন উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করল– প্রশ্ন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে–
তারা বলে গেল "ক্ষমা করো সবে', বলে গেল "ভালোবাসো--
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো'।
বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।।
আমি-যে দেখেছি গোপন হিংসা কপটরাত্রি–ছায়ে
হেনেছে নিঃসহায়ে,
আমি-যে দেখেছি– প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।।
কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,
অমাবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে,
তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে–
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?।