যে শহরে তুমি থাকো

 আজও তোমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিলাম সেই কাকভোরে; তোমার শহরে, তোমার ওলি-গলিতে।

তুমি তখন ভোরের স্বপ্ন নিয়ে বালিশে মাথা গুঁজে হাসছো।ভারি সুন্দর সেই হাসি। গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে জলের শব্দের সঙ্গে ভেসে আসছিল দূর থেকে। তোমার প্রিয় পারফিউম তোমার অজান্তেই এসে স্পর্শ করেছিল আমাকে।আমি হাওড়া স্টেশনের গায়ের সঙ্গে মিশে। আমি কাউকেই বুঝতে দেইনি যে আমি এসেছি তোমার খোঁজে। কারণটা কিছুই নয়, আমি পরেছিলাম খয়েরি রঙের সালোয়ার।




আগে আগে ডাকবাক্সে তোমার চিঠি পেতাম।এখন কেন জানি না আর পাইনা।তাই ডাকবাক্স রং পরে গিয়েছিলাম তোমার খোঁজে ।যদি তুমি চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকো ।হয়ত বা ক্লান্ত হয়ে বাড়িমুখো হতে চাইছো। তখন সেই আমি পিছন থেকে তোমাকে জড়িয়ে ধরে বলবো - “আর অপেক্ষা করতে হবে না তোমাকে।আমি তো জানতে পারিনি যে ডাকবাক্স গুলোর ভীষণ অসুখ করেছে ।না জানি কোথায় ট্রিটমেন্ট চলছে। আমি এসেছি তোমার সমস্ত চিঠি নিয়ে যেতে। তোমার ভালোবাসা, তোমার স্বপ্ন, তোমার একাকীত্ব, তোমার প্রিয় মানুষ, তোমার কষ্ট, তোমার না পাওয়া…..।

রোজ সন্ধ্যায় বাড়ীর ছাদে উঠলে তারাদের জলসা শুনতে পেতাম। তুমি মধ্যেমনি হয়ে ঐ..ঐ..ঐ যে গো ,ঐ গানটা…ডন উইলিয়ামসের গাওয়া গানটা…. “You are my best friend" তুমি গাইছিলে। কালো টিশার্ট,নেভি ব্লু জিন্স, চোখে কালো‌ ফ্রেমের চশমা। চুলগুলো ঈষৎ এলোমেলো । তোমার ঐ শতাব্দী প্রাচীন হাসিটা বেশ মানিয়ে যায় গানের সাথে। হাতের ফুলে ওঠা নীলচে শিরাগুলো গীটারে‌ সুর তোলে নিখুঁত, নিপুণ ভাবে। হঠাৎ, একদিন দেখলাম তুমি নেই! ভাবলাম তুমি হয়ত বাড়ী ফিরেছো। তাই তো ছুটে চলে গিয়েছিলাম তোমাকে জানতে - আমি যত্ন করতে চাই; মায়ের মতো।

শ্যামবাজার, কলেজ স্ট্রিট, বড়বাজার হয়ে বাবুঘাট;যখন হাঁটছিলাম তখন চোখ জোড়া শুধুই খুঁজে চলেছিল তোমার ব্যস্ত দুপুর,ভাত ঘুম, কিংবা জানলার পাশে বসে মাউথ অর্গান। তুমি সদ্য ভেজা চুলে টেরি কেটে এসে অবাধ্য ছেলের মত বলেছিলে -”হারিয়ে যাই‌নি তো! আমি তো ছিলাম তোমার পাশেই,গলির বাতাস, উষ্ণ রোদ, শহরের চাঁদোয়া আকাশ‌ হয়ে, মাটির ভাঁড়ে গরম চা হয়ে, তৃষ্ণার জল হয়ে, শহরের বিপুল কলরব হয়ে।”তুমি আরো আমার কাছে এগিয়ে এসে দুহাতের মধ্যে আমার মুখখানি তুলে নিয়ে বলেছিলে -”এই মিথ্যে শহরে এসে, তোমার ওড়না, হাতের ঘড়ি,কানের দুল, ক্লান্ত হয়ে গেছে। তুমি বাড়ী ফিরে যাও।”আমার চোখে তখন দাঙ্গায় হেরে যাওয়ার আহত সৈনিকের ঘোলাটে দৃষ্টি,আর পাশের নদীতে ঘোলাটে জলে জোয়ারের লবনাক্ত খরস্রোত। আমি অবাক -কেন যাব শুনি!
তুমি বলেছিলে - জনসমুদ্রে, তোমাকে আর কেউ চিনে ফেলুক,তা আমি চাইনা। তুমি আমার। আমি ছাড়া আর কেউ তোমাকে খুঁজে নিক আমি হতে দেব না।
তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে বসন্তের আবীরের মতো।”তুমি এত সাধারণ, তোমাকে যে কেউ খুঁজে নেবে। রঙিন মুখের রেখায় তুমি তো মিলিয়ে যাবে না। দেখছো না সবাই কত ব্যস্ত! এই পৃথিবীকে কত কিছু দেওয়ার আছে ওদের। ব্রেক আপে অন্ধকার বারান্দা, বৃদ্ধাশ্রমে স্যাঁতস্যাতে দেওয়াল, পেশেন্টপাটিকে মানি ট্রান্সফারের পিন মনে করানো, শহরের রাজপথে অবহেলিত প্রতিভার রামধনু প্যালেট….। তোমার আমার তাড়া নেই। অক্সিজেন ছাড়া আর কি দিতে পারি বলো।তাই ফিরে যাও। আবার তুমি অনেক অক্সিজেন নিয়ে আসবে।আমি থাকবো তোমার পথ চেয়ে। তোমার ভয় নেই,ঐ লাল ঢলে পড়া সূর্যটা তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবেই ও বাড়ি ফিরবে। 

আমি আর ও একবার সজোরে জড়িয়ে ধরেছিলাম। 

কতগুলো এলোমেলো বাতাস রীতিমতো আমাকে জোর করে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল। ট্রেনের জানলার ধারে বসে সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ প্রায় বন্ধ।দূর থেকে তোমার ক্ষীন গলার স্বর ভেসে আসছিল। চন্দ্রবিন্দুর ভিনদেশী তারা।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!