আজ বড্ড ঠান্ডা পড়েছে।
বিলু চাদরটা ভালো করে গায়ে চাপিয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটছে।মরা জ্যোৎস্নায় সরষে খেতের আল ধরে হাঁটতে বিলুর বেশ ভালোই লাগছিল কিন্তু রাতের বেলায় কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ পিছু নিয়েছে।বার দুয়েক পিছনে ফিরে তাকিয়ে ও কোন কিছু দেখতে পায় না।খানিক ভয়ে ভয়ে সামনে এগিয়ে চলে।
সামনের তেঁতুল গাছটার কাছে আসতেই বুঝতে পারল ও পাশের গ্ৰামের সামনেই চলে এসেছে।আজ এত বছর ধরে যাতায়াত করছে এমন ভুল তো হয় না! মনে মনে প্রমাদ গুনে আবার হাঁটতে শুরু করল নিজের গ্ৰামের উদ্দেশ্য।
রাত প্রায় গভীর।
কী আশ্চর্য, আবার তেঁতুল তলা!প্রায় বার পাঁচেক এই তেঁতুল তলাতে এসেছে।এমন সময় খনখনে গলায় কে যেন বলে উঠল –হ্যাঁ রে বিলু,বলি তোর ঘটে কি পচা পাঁক পুরে রেখেছিস?
বিলু ভয়ে চারিদিক তাকাতে লাগল। আবার বলে উঠল
–ঘটটাকে অত না নাড়িয়ে ঠোঁটটা নাড়ালে তো ল্যাঠা চুকে যেত।
বিলু শুকনো কাষ্ঠের ন্যায় গলায় বলল - কে?
খনখনে গলা এবার ধমকের সুরে বলল - ছোটোবেলায় যার কোলে ইয়ে করে বড় হয়েছিস হতভাগা।বলে কি না কে।
বিলু একটু নরম হয়ে বলল -কে দাদু?
-আর দাদু! এবার অনেকটা দুঃখ নিয়ে বলল।মরে গিয়েছি- মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ও চুকেছে এখন নতুন নাম হয়েছে কানাভুলো।
বিলু মনে মনে রেগে বলল -এ আর নতুন কি, বেঁচে থাকতে একপ্রকার কানাভুলোই ছিলে।
মনের কথা বুঝে এবার একেবারে খনখন্ থেকে ঝনঝন্ করে উঠে বলল -এই বিষ্ঠা,কি বললি রে? আমি কানাভুলো ছিলাম?তারপর নাকে কেঁদে বলল -তা তো বলবি , কাঁধে চড়িয়ে সারাক্ষণ ঘোরাতাম কিনা।ব্যাটা হাড়গিলে কোথাকার।
শেষের কথা গুলো দাঁতে দাঁত চেপে বলল তবে ফোকলার জন্য তেমন শোনালো না।বিলু রেগে বলল –আবার তুমি গালিগালাজ করছো! এই জন্য তোমার ধর্ম সইল না।সাধে কি আর কাঁধে নিয়ে ঘোরাতে, ধান্দা ছিল তো।
–ওরে হাড়গিলে, কাঁধে নিয়ে ধান্দা শিখেয়েছিলাম বলে আজ দুটো পয়সা ট্যাঁকে নিয়ে ঘুরিস। হুঁ, দুদিনের ছোকরা আমাকে ধর্ম শেখাচ্ছে। বুড়ো কথা গুলো বলেছিল বিলুকে থামিয়ে। বিলু তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বলল - তুমি তো শুধু পাখি রং করতে শিখিয়েছিলে,ওতে কত পয়সা হয় শুনি?
—হ্যাঁ,ওটাই তোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল। শেষে কিনা হনুমানের বাচ্চাকে রং করে মানুষের বাচ্চা বলে বিক্রি করবি! বংশের নাম না ডুবিয়ে ছাড়বিনা দেখছি ।
– বেশ করেছি।আর ও করব। তোমার বংশকে দুনিয়া ছাড়া করব। গাধাকে গরু,বিড়ালকে বাঘ, কুকুরকে শেয়াল,আর যাকে যাকে হাতের কাছে পাব;সব শালাকে রংকে বিক্রি করব।বিলু একটা কড়া ভাব নিয়ে একটা অধিকারের আধিপত্য বিস্তার করে কথা গুলো বলে ফেলল।
–এবার বউটাকে না রং করে বিক্রি করে দিস!যাক গে তোর বউ রং করবি না পেন্ট করবি তোর ব্যাপার ।
–তা তোমার মতলবটা কি বলত? শীতের রাতে এমন করে ঘোরানোর কী দরকার ছিল?বিলুর রাগ যেন পঞ্চমে।
বুড়ো নরম হয়ে বলল - আহা চটছিস কেন?শোন না ট্যাকেঁ করে কী খাবার নিয়ে যাচ্ছিস রে?
–কেন?
–কতদিন ভালো খাবার খাই না। বেঁচে থাকতে গ্যাস, অম্বলের জ্বালায় জলটুকু খেয়েও শান্তি ছিল না।তাই বলছিলাম যদি একটু দিতিস আরকি।আয় না দাদু নাতি মিলে বসে খাই। বুড়োর দুঃখ নাক দিয়ে ঝরে পড়ছে।
–মরেছো এক যুগ হল।তা এতদিন কী খেয়ে থাকতে।
বুড়ো নাক টেনে বলল –এখন সব বড় বড় রাস্তা হয়েছে।গাড়ী করে সোঁ সোঁ করে চলে যায়। মাঠের মধ্যে দিয়ে কেউ যায় না দাদু। একমাত্র তুই হাড়কিপ্টে,পায়ে হেঁটে মাঠের মধ্যে দিয়ে যাস।যাস তো যাস তোকে বাগে আনাটা খুব মুশকিল। আমার বংশ কিনা।
বিলু রাতের অন্ধকারে ভ্রু নাচিয়ে বলল –আজ পেলে কী করে?
–আজ তোর বয়েস ষাট।যখন তুই জন্মে ছিলি তখন তোর ঠাকুমা যত রাজ্যের নজরকাঠি হয়,সব ঘুনসির সাথে তোর কোমরে বেঁধে দিয়েছিল। এতদিন কোমরে রেখেছিস দেখে কি ভালো লাগত। গিন্নির কথা মনে পড়ত।আজ সে গুলো খুলে পড়েছে রে। শেষের কথা গুলো রেগে বলে একেবারে বিলুর ঘাড়ে এসে পড়ল।
বিলু কোনকিছু না বলে কি একটা ভাবছে।তারপর খাবারের থলিটা বুড়োকে দিয়ে দিল। খুশি খুশি বুড়ো বলল -হ্যাঁ রে বিষ্ঠা,কী অত ভাবছিস? মাটিতে রং করে নজরকাঠির ব্যবসার কথা? আমি বলি কি তুই ফলের বীজ গুলো রং করে দেখতে পারিস। বিলু কিছু না বলে বাড়ীর পথে পা বাড়ালো।
যেতে যেতে বিলু শুনতে পেল বুড়োর চিৎকার।বুড়ো চিৎকার করে বলছে –ব্যাটার ছেলে হাড়গিলে বিষ্ঠা, নারকেল ছোবড়া আর স্পঞ্জ রং করা পাউরুটি আমাকে দিয়েছিস! ভালো মন্দ খাবার দিলি নে। বলে রাখছি পেট ছাড়বে তোর। হতছাড়া…. হারামজাদা যে বলিনি তোর দাদুর ভাগ্য ভালো। আরে আমি তো দাদু…….না…….. কথা ক্রমশ ক্ষীন হয়ে আসে।